শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায়। ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মাধ্যমে তার অপসারণ দেশের নেতৃত্বে একটি শূন্যতা তৈরি করে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে পূরণ করা হয়, এবং এই সরকারের অন্যতম পরামর্শদাতা হিসেবে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস, যিনি মাইক্রোফাইন্যান্স ও দারিদ্র্য বিমোচনে তার কাজের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন। ২০২৪ সালের শেষের দিকে তার আমেরিকা সফর আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছে, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও তার প্রধান প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনের চেষ্টা; ড. ইউনূসের আমেরিকা সফরকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তর্জাতিক বৈধতা ও সমর্থন পাওয়ার প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওয়াশিংটন সফরের সময় তিনি মার্কিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যার মধ্যে ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিরা। এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার রক্ষার পক্ষে কথা বলে আসছে, এবং ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী নেতৃত্বকে তারা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা আশাবাদী যে ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের নতুন পথ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে তার মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কাজ তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট পরিচিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে, বিশেষত বর্তমান ইন্দো—প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ—রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া: যেখানে পশ্চিমা কূটনৈতিক মহল ড. ইউনূসের সফরকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে, সেখানে ভারত থেকে এই সফরকে কিছুটা সতর্ক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে ভারত সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে। হাসিনার শাসনামলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছিল, যা মূলত নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টায় দৃঢ় ছিল। তবে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ভারতের জন্য বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি কৌশলগত অংশীদার, বিশেষ করে উত্তর—পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ও ক্রস—বর্ডার সমস্যাগুলি সমাধানে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কিছু আন্দোলনকারীর মধ্যে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলেছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা ভাবছেন, বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্ব কি ভারতের সাথে আগের মতোই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবে, নাকি তাদের পররাষ্ট্রনীতি নতুন পথ বেছে নেবে?
বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রনীতি এবং চীনের ভূমিকা: ড. ইউনূসের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার একটি নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ভারত, চীন এবং পশ্চিমা শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবে। শেখ হাসিনার শাসনকালে চীনের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছিল, তবে ভারত ও পশ্চিমা শক্তির সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে তিনি সফলভাবে এই ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার হয়তো চীনের সাথে দূরত্ব তৈরি করে পশ্চিমা শক্তির দিকে আরও ঝুঁকবে বলে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের ধারণা।
বিশেষত, বাংলাদেশ তার অর্থনীতির জন্য ভারতীয় পণ্য সরবরাহের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল, গম, পেঁয়াজ, তুলা, ইস্পাত প্রভৃতি পণ্য আমদানি করে থাকে। যদি বাংলাদেশের নতুন সরকার ভারতের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য পরিবর্তন করে, তাহলে এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত এই পরিস্থিতিতে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় নতুন কৌশল তৈরি করতে বাধ্য হবে।
ভারতের কৌশলগত প্রতিক্রিয়াঃতবে, ভারতের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত বেশ কূটনৈতিকভাবে পরিমাপ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এখন পর্যন্ত ড. ইউনূস বা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য সমালোচনা করেননি। বরং, ভারত বাংলাদেশের সাথে তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রাখার জন্য সম্পর্কের সেতুবন্ধন বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ড. ইউনূস নিজেও ভারতকে আশ্বস্ত করেছেন যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এবং সীমান্ত নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সহযোগিতা তার সরকারের জন্য অগ্রাধিকার পাবে।
ভারতের উদ্বেগের মূল কারণগুলো হলো, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর তাদের নির্ভরতা। বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ সংযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভারত বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চাইবে।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ:বাংলাদেশের এই অন্তর্বর্তী সময়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মহল আগ্রহী। অন্যদিকে, ভারত কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সাথে তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে চাইবে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশও এই সময়ে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং রাজনৈতিক অসন্তোষ মেটাতে সচেষ্ট থাকবে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার কিভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং কৌশলগত সম্পর্কগুলিকে পরিচালনা করবে, সেটি হবে দেখার বিষয়।ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ (ধারাবাহিকতা)
এই অন্তর্বর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি গভীরভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ড. ইউনূস, একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল বিজয়ী হিসেবে, তার নেতৃত্বকে এমন এক সময়ে প্রতিষ্ঠিত করছেন যখন বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ভারত, চীন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলির মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় আনতে পারে।
ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক কীভাবে পুনর্নির্মাণ করা হবে, তা বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপগুলির উপর নির্ভর করবে। ভারতের প্রধান উদ্বেগ হলো সীমান্ত সুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। যদি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সাথে কৌশলগত সহযোগিতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়, তবে তা দুই দেশের জন্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে, যা উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অপরিহার্য।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের জন্য পশ্চিমা শক্তির সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন সুযোগও আসতে পারে। ড. ইউনূসের আমেরিকা সফরের ফলে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও সমর্থন পেতে পারে।
ভারতের ভবিষ্যৎ কৌশলঃবাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ভারত তার কৌশলগত পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে। বিশেষ করে সীমান্ত সমস্যা, নিরাপত্তা চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করার প্রয়োজন হতে পারে। যদি বাংলাদেশের নতুন সরকার চীনের সাথে তার সম্পর্ক বাড়াতে চায়, তবে ভারত এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ চীনের ভূ—রাজনৈতিক ভূমিকা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
তবে, সামগ্রিকভাবে ভারত—বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে উভয় দেশের নেতৃত্বের উপর। যদি ড. ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয়ই কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হন এবং পারস্পরিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন, তবে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি শক্তিশালী হলে, এটি ভারতসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি স্থিতিশীলতা আনবে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার আমেরিকা সফর বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার পাশাপাশি, ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি নির্ধারণ করবে তার গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক ভূ—রাজনীতির উপর প্রভাব।
মোঃ নুরুল হক
লেখক আইইউবিএটি—এর ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক এবং ইউপিএম—এর পিএইচডি প্রার্থী।