মো: নুরুল হকঃ আর্জেন্টাইন বিপ্লবী মার্কসবাদী, ডাক্তার, এবং গেরিলা নেতা আর্নেস্তো “চে” গুয়েভারা কিউবান বিপ্লবে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে অংশগ্রহণের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করা চে গুয়েভারা প্রতিরোধের প্রতীক, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং সামাজিক সমতার সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক।
তার রাজনৈতিক আদর্শে মার্কসবাদ গভীর প্রভাব ফেলেছিল, এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে সশস্ত্র সংগ্রামই সমাজতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের একমাত্র উপায়। চে’র মতে, প্রকৃত বিপ্লবের জন্য নির্যাতিত শ্রেণিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। শুধুমাত্র লাতিন আমেরিকায় নয়, গোটা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের জন্যও বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তি সম্ভব।
“হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিয়েম্প্রে”, চে’র রাজনৈতিক দর্শনের মূল প্রতিফলন, যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “বিজয় পর্যন্ত, সর্বদা”। এটি তার বিপ্লবী চেতনাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে তিনি সুবিচার এবং সমতার জন্য অটল থাকার কথা বলেন। এই বাণীটি বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং বিশ্বব্যাপী বিপ্লবীদের মাঝে চিরস্থায়ী আন্দোলনের মন্ত্র হিসেবে পরিচিত। তার ভাষায়, অত্যাচার সর্বত্র একই রূপে আসে, তাই বিপ্লবকেও কোন সীমানা মানা উচিত নয়।
আজকের দিনে বাংলাদেশে ছাত্র—জনতার নেতৃত্বে চলমান আন্দোলনে চে গুয়েভারার আদর্শ একটি নতুন অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছে।
সামাজিক অবিচার,
বৈষম্য,
এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান এই আন্দোলন চে’র সংগ্রামের প্রতিধ্বনি।
চে’র মতো তারাও এমন একটি সমাজ চায় যেখানে সততা,
ন্যায়পরায়ণতা,
এবং সত্যকে মূল্যায়ন করা হয়।
বাংলাদেশের আরেক বিপ্লবী নেতা, আবু সাইয়েদ, ছিলেন সেই চেতনার একজন মূর্ত প্রতীক, যিনি একদিকে অবিচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং অন্যদিকে সমাজের সাধারণ জনগণকে মুক্তির পথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাইয়েদের সংগ্রাম তার দেশকে বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ছিল। তরুণ প্রজন্মের মাঝে তার অনুপ্রেরণা চে গুয়েভারার মতোই শক্তিশালী এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মূল মন্ত্র।
আবু সাইয়েদ এবং চে গুয়েভারার বিপ্লবী দর্শনের মাঝে একাধিক সাদৃশ্য রয়েছে। চে গুয়েভারা যেখানে লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেখানে আবু সাইয়েদ বাংলাদেশের শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। তাদের আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল মুক্তি, সমতা এবং ন্যায়বিচারের লড়াই, যা তাদের যুগের নিপীড়িতদের জন্য পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিল। তবে, চে গুয়েভারার সংগ্রাম ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে মুক্তির জন্য, যেখানে আবু সাইয়েদ তার দেশের জনগণের জন্য স্থানীয় শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
চে গুয়েভারা যেমন তরুণদের বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখেছিলেন, তেমনি আবু সাইয়েদও বাংলাদেশের যুবসমাজের উপর ভরসা করেছিলেন। উভয়ের দর্শনই ছিল সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়ন করা এবং অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা। তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন তারা, যা আজকের ছাত্র—নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলোতে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
চে’র বিপ্লবী পথ ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ এবং গেরিলা কর্মকাণ্ড, যেখানে আবু সাইয়েদ নেতৃত্ব দিয়েছেন মূলত চিন্তার বিপ্লবের মাধ্যমে। তার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলা এবং শোষণমূলক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। তবে, উভয়ই বিশ্বাস করতেন যে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়তে হলে ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ অপরিহার্য।
আজকের বাংলাদেশের বৈষম্য, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং অবিচারের প্রেক্ষাপটে আবু সাইয়েদের জীবন এবং সংগ্রাম তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। যেমন চে গুয়েভারার নাম বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, তেমনি আবু সাইয়েদের আদর্শ বাংলাদেশে একটি নতুন আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। আজকের ছাত্র সমাজ তার দেখানো পথে অবিচল থেকে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে পারে। উভয়ের আদর্শই সার্বজনীন এবং কালের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের হৃদয়ে বিপ্লবের আলো জ্বালিয়ে যেতে থাকবে।
উত্তরবঙ্গের জনগণের সংগ্রামেও আমরা চে গুয়েভারা এবং আবু সাইয়েদের আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাই। যেমন চে গুয়েভারা লাতিন আমেরিকায় শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তেমনি আবু সাইয়েদও বাংলাদেশের শোষিত মানুষের জন্য লড়াই করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত এবং বঞ্চিত থেকেছে, তাদের সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ সত্ত্বেও তারা ন্যায়বিচার পায়নি। আবু সাইয়েদ উত্তরবঙ্গের একজন অন্যতম সাহসী প্রতিনিধি, যিনি তার জীবন উৎসর্গ করে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তার আত্মত্যাগ উত্তরবঙ্গের মানুষের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
উত্তরবঙ্গের মানুষ সবসময়েই বিনয়ী এবং সরল স্বভাবের, তারা প্রায়ই ‘মফিজ’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা জাতির সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগকারী। যখন সারা দেশের জনগণ নতুন গণতন্ত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হতে চেয়েছিল, তখন উত্তরবঙ্গের মানুষই প্রথম শোষণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। আবু সাইয়েদ তার বুক উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, শোষকের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে উত্তরবঙ্গের মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনোই মাথা নত করবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আজকের দিনেও এই অঞ্চলের জনগণ অবহেলিত থেকে যাচ্ছে।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সবসময় দেশের দক্ষিণ এবং মধ্যাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, অথচ উত্তরবঙ্গের মানুষ এখনও উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এবং কর্মসংস্থানের সুবিধাগুলি এখনও উত্তরবঙ্গ থেকে দূরে। এভাবে বঞ্চনা এবং অবহেলার মধ্যে থেকেও উত্তরবঙ্গের মানুষ চুপ করে থাকেনি। বরং তারা নতুন গণতন্ত্রের সংগ্রামে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।সর্বপ্রথম আবু সাইয়েদ নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে শোষণ মুক্ত করার সংগ্রামে প্রথম হলেও, দেশ গঠনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মাঝে আমার উত্তর বঙ্গের কেউ নেই। যত গুলো ভিসি, ডি সি, সচিব ও উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সেখানে আমার উত্তর বঙ্গের কেউ নেই। এখানে কি যোগ্য মানুষ নেই? নাকি যোগ্যতার মাপকাঠি শুধু টাকা আর গলাবাজি!
আবু সাইয়েদ যেমন চে গুয়েভারার মতো সাহসের প্রতীক ছিলেন, তেমনি উত্তরবঙ্গের প্রতিটি মানুষও সংগ্রামের প্রতীক। আজকের বাংলাদেশে নতুন গণতন্ত্রের আলোয় উত্তরবঙ্গের মানুষও নতুন করে আলো দেখতে চায়। তারা আশা করে যে তাদের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন হবে, এবং তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে। উত্তরবঙ্গের মানুষ চায়, তাদের ভূমির উন্নয়ন হবে এবং তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করবে।
শেষ পর্যন্ত, চে গুয়েভারা এবং আবু সাইয়েদ কেবল দু’টি নাম নয়; তারা প্রতীক হয়ে উঠেছে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, এবং সর্বোপরি, নতুন প্রজন্মকে পরিবর্তনের পথ দেখানোর। আজকের ছাত্র—নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলো এই দু’জন মহানায়কের আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছে, এবং তারা জানে যে সংগ্রাম সবসময়ই বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়, যতদিন পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত থাকে।
লেখক আইইউবিএটি—এর ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক এবং ইউপিএম—এর পিএইচডি প্রার্থী।