প্রকৃতির বৈষম্য সত্ত্বেও, উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ সহিষ্ণুতা। তাঁরা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন—বন্যা, খরা ও প্রতিবেশী ভারতের প্রতিহিংসামূলক আচরণের মুখোমুখি হয়েও কখনো ভেঙে পড়েন না। ভারতে অতিবৃষ্টি হলে ভারতের স্লুইসগেট খুলে দেয়া হয়, ফলে উত্তরবঙ্গের ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়, যা এখানকার জনগণকে ভোগান্তির শিকার করে। তখন, তাঁদের খাদ্য সংকট এবং মূল্য বৃদ্ধির শিকার হতে হয়, যা স্থানীয়ভাবে ‘মঙ্গা’ নামে পরিচিত। অন্য এলাকার মানুষও তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা করে এবং মঙ্গা—আক্রান্ত বলে উপহাস করে। তবুও তাঁরা হাল ছাড়েন না, বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যান।
তবে তাঁরা কখনও সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান না এবং দেশের অন্য অংশের মানুষের কাছে কোনো সহানুভূতি প্রত্যাশা করেন না। আমরা তাঁদের যেন জন্মগতভাবে দুর্ভাগ্যের জন্য নিযুক্ত মনে করি। কয়েকদিন আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বন্যায় বিধ্বস্ত হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের সাহায্য করতে—মানুষ ও সরকার মিলে এই জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার ও পুনর্বাসন করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
কিন্তু বর্তমানে উত্তরবঙ্গে আবারও মারাত্মক বন্যা দেখা দিয়েছে, যা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু মিডিয়া যেন চোখ বন্ধ করে রেখেছে, কোনো খবর নেই, না আছে সাহায্যের আহ্বান, না আছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার কোনো চেষ্টা। কেন এই বৈষম্য? উত্তরবঙ্গের মানুষ কি দারিদ্র্যপীড়িত বলে অবজ্ঞার শিকার? অন্যরা কি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বলে তারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
বৈষম্য—বিরোধী আন্দোলনের সময়, উত্তরবঙ্গের মানুষও রাস্তায় নেমে এসে স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। আমাদের আবু সাইয়েদ বুক পেতে দিয়েছিলেন লোভাতুর ক্ষমতার নির্মম গুলির সামনে, যা ছিল শেখ হাসিনার অপশাসনের পতনের মূল কারণ। এই ঘটনাই ছিল স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে উত্তরবঙ্গের একজনও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাননি। সেখানে কি কোনো যোগ্য প্রার্থী ছিল না?
যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তার কোনোটাই উত্তরবঙ্গের মানুষদের কল্যাণে কাজে আসেনি। নেই কোন উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কিংবা গার্মেন্টস শিল্প। সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না, যেন সৃষ্টিকর্তা নিজেই তাঁদের বৈষম্যের শিকার বানিয়েছেন।
দেশের অন্যান্য অঞ্চল—চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশালের মানুষরা এয়ারকন্ডিশন ট্রেন, বাস ও আধুনিক সড়ক ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করছেন, এমনকি বঙ্গবন্ধু টানেল ও পদ্মা সেতুর সুবিধাও পাচ্ছেন। অথচ উত্তরবঙ্গের মানুষ চলাচল করেন ভাঙাচোরা বাসের ছাদে, ট্রাকে, কিংবা লেগুনায়। তাঁদের “মফিজ” নামে তাচ্ছিল্য করা হয়, কিন্তু “মফিজ” হওয়ার বাস্তব গল্প অনেকের মুখ বন্ধ করে দিতে যথেষ্ট।
এরশাদের শাসনামলে উত্তরবঙ্গের জন্য খুব কম কাজই হয়েছে। জিয়াউর রহমান কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তা পূর্ণতা পায়নি। খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় থেকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি শেখ হাসিনাও, যিনি এই অঞ্চলের মেয়ে হয়ে আছেন, উত্তরবঙ্গের মানুষের উন্নয়নে কিছুই করেননি।
অতঃপর, শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারী শাসককে অপসারণের পরে, আমরা আশা করি যে উত্তরবঙ্গের এই নিরীহ, সরল এবং বঞ্চিত মানুষদের প্রতি সুবিচার করা হবে। যাতে বৈষম্য—বিরোধী আন্দোলন তার প্রকৃত নামের সার্থকতা প্রমাণ করতে পারে। উত্তরবঙ্গের সহিষ্ণুতা ও অবদান ভুলে গেলে চলবে না। দেশের পুনর্গঠনের সাথে সাথে উত্তরবঙ্গেরও উন্নতি ও ন্যায়বিচার প্রয়োজন—যা বহুদিন ধরেই তাঁদের প্রাপ্য ছিল, কিন্তু দেওয়া হয়নি।
মোঃ নুরুল হক
লেখক আইইউবিএটি—এর ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক এবং ইউপিএম—এর পিএইচডি প্রার্থী।