দেশের সার্বিক উন্নয়নের মাপকাঠি যে শিক্ষা, এ কথা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ভুলে যান। তারা মনে করেন,আসল হলো রাজনীতি। শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলে সরকার কিন্তু মান নিয়ে কোন কথা বলে না। কী শিখছে শিক্ষার্থীরা, তা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে লাখ লাখ। তারা আবার উচ্চশিক্ষায় গিয়ে ঝরে পড়তেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে, তারা এক বা একাধিক শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা কমিশন গঠন করে ছিল। কিন্তু সেই কমিশনের সুপারিশ বা নীতি বাস্তবায়নের আগেই সরকারের ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। সময় সংকীর্ণতার কারণে তারা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি।
সেদিক থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। দুর্ভাগ্য হলো এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষানীতির মৌলিক কোনো ধারাই বাস্তবায়িত হয়নি। হয়নি শিক্ষার মান উন্নতি। আসলে শিক্ষা নিয়ে কাজের চেয়ে কথাই বেশি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিক অনুষ্ঠানে বলে ছিলেন, এত দিন শিক্ষা সংখ্যায় বেড়েছে, এবার মানের দিকে নজর দেব। কিন্তু কেন এত দিন সংখ্যায় বাড়ল এবং মানের অবনতি ঘটল, সেই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই। শিক্ষার মানের অবনতির অন্যতম কারণ নীতিনির্ধারকদের সীমাহীন উদাসীনতা এবং পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থী উত্তরপত্রে কিছু লিখুক আর না-ই লিখুক, তাকে পাস করিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল শিক্ষকদের প্রতি। বলা হয়েছিল কাউকে ফেল করানো যাবে না।
বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কেউ ফেল করুক, তা কারও কাম্য নয়। কিন্তু পাস করতে হবে পড়াশোনা করেই। সে জন্য প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষমুখী করা। নিয়মিত পাঠদান করা কিন্তু তা করা হয়নি। শিক্ষার অবনতির আরেকটি কারণ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকরণ। এমপি ও রাজনৈতিক কান্ডজ্ঞানহীন নেতারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির আসন দখল করে ভর্তি-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। তাদের দখলে তাদের চামচারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ছড়ি ঘোরান। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে চলবে এবং শিক্ষার মান বাড়বে, এটি আশা করা দূরাশামাত্র।
শিক্ষা হলো অনেকটা বহুতল ভবনের মতো। এর ভিত যত শক্ত হবে, ওপরে তলাও তত বাড়ানো যাবে। কিন্তু অতীতের মতো বর্তমান সরকারের আমলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সবচেয়ে উপেক্ষিত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে কোন নজর দেওয়া হচ্ছে না। পরীক্ষায় পাস ও জিপিএ–৫ পাওয়ার হার যত বাড়ছে, শিক্ষার মান ততই কমতেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৪/৫ শতাংশ কৃতকার্য হয়েছিলেন, বাকি ৯৫/৯৬ শতাংশ অকৃতকার্য। সরকার যে ধারায় বুনিয়াদি ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে হয়তো ভবিষ্যতে শতভাগই অকৃতকার্য হবেন বলে আশঙ্কা করি। শিক্ষার অবনতির আরেকটি বিশেষ কারণ হলো বিতর্কীত ভ্রান্ত বিষয় পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা। শিক্ষার কোন উন্নতি নেই ভুলভ্রান্ত শিক্ষা দিয়ে জাতিকে মূর্খ বানানো হচ্ছে। বর্তমানে দিন যত যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
রাষ্ট্র নিজে এই খারাপ করার দায়িত্ব নিয়েছে। রাষ্ট্র দায়িত্বশীল হলে এত অবনতি হওয়ার কথা ছিল না। ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের এত পরিবর্তন হয় না। বছরের পর বছর ধরে একই পাঠ্যবই পড়ানো হয়। আর অন্যদিকে বিজ্ঞান, বাংলা ও ধর্মের পাঠ্যবইয়ে বছর না ঘুরতেই পরিবর্তনের পালা জুড়ে বসে। প্রতিবছর কিছু না কিছু বিতর্কীত বিষয় যোগ করা হয়। সবচেয়ে বড় বিপদের কথা হচ্ছে, পাঠ্যবই রচিত হচ্ছে নকল করে। শিক্ষার্থীরা নকল করা বই পড়ছে। নকল করাকে রাষ্ট্র নিজেই উৎসাহ দিচ্ছে। নকলকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। নকলের এই প্রবণতা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বত্রই বিদ্যমান। এমন কোনো স্তর পাবেন না, যে স্তরে নকল বই নেই। শিক্ষকরা গবেষণাপত্র জমা দিচ্ছেন নকল করে! এভাবে করে কোনটা সৎ আর কোনটা অসৎ তা বোঝার উপায় থাকছে না। আর যারা নকল করে পাঠ্যপুস্তক লিখছেন আর যারা সম্পাদনা করছেন, তারা তো দায়িত্ববান। তাহলে দায় নিচ্ছেন না কেন? রাষ্ট্র কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তার মানে রাষ্ট্র এমন নকল ব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়েছেন। ধরা না পড়লে রাষ্ট্রের সবাই সৎ। ধরা পড়লেই কেবল অসুবিধা। শিক্ষার এই সর্বনাশ অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন।
✍ লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
শিক্ষার্থী, আল- আজহার বিশ্ববিদ্যালয়
কায়রো, মিশর